Knowledge Share

বিশ্ব মৌমাছি দিবস আজ

সুন্দরবনের বন্ধু মৌমাছিবাংলা ব্যাকরণে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় সমাস অনুযায়ী মৌমাছি হলো মৌ আশ্রিত মাছি। সাধারণ মাছির দুটি পাখা থাকে। কিন্তু মৌমাছির পাখা চারটি। অতিরিক্ত দুটি পাখা তারা মধু ধারণ ও বহনের কাজে লাগায়। পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। আমাদের দেশে সাধারণত পাঁচ রকম মৌমাছির দেখা মেলে। সারা দেশে এদের দেখা মিললেও সুন্দরবনে মাত্র দুটি প্রজাতি—এপিস ডরসেটা ও স্ট্রিং-লেস মৌমাছির দেখা পাওয়া যায়।

এপিস ডরসেটা মৌমাছি বড় আকৃতির। তারা কিছুটা আগ্রাসী। পোষ মানে না। বড় গাছে, উঁচুতে, বাসাবাড়ির কার্নিশে বাসা তৈরি করে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে এরা সুন্দরবনে চলে যায়। দুই থেকে আড়াই মাস সেখানে থাকে। এ কারণে এ সময়ই সুন্দরবন থেকে প্রচুর মধু সংগ্রহ করেন মৌয়ালেরা।

স্ট্রিং-লেস মৌমাছি অত্যন্ত ছোট আকৃতির হয়। জ্যান্ত গাছের প্রাকৃতিকভাবে তৈরি গর্ত বা ঢোরের ভেতর বাসা তৈরি করে তারা। গাছ চিড়ে এদের মধু সংগ্রহ করতে হয়। অন্য সব মৌমাছির বাসা ষড়ভুজাকৃতির হলেও এদের ঘর গোলাকৃতির হয়। খুব কম মধু পাওয়া যায় এদের বাসা থেকে।

মৌমাছি থেকে মধু, মোম পরাগ, রয়েল জেলি ও বিষ পাওয়া যায়। পৃথিবীর অন্য কোনো পতঙ্গ থেকে এত দামি ও প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়ার নজির নেই বললেই চলে।আমাদের দেশে খামারিরা বাক্সে যে মৌমাছি পালন করেন, তা এপিস মেলিফেরা প্রজাতির। ইউরোপিয়ান জাতের এই মৌমাছি একদম সহজে পোষ মানে এবং প্রচুর মধু উৎপাদন করে থাকে। পোষ মানে এমন আরেকটি মৌমাছি হলো দেশীয় এপিস সেরেনা প্রজাতির। এরা গাছের গর্তে, মাটির ঢিবির ভেতর বাসা তৈরি করে। রানিসহ ধরে এনে বাক্সে আটকে রাখলে পোষ মেনে যায়। সুস্বাদু মধু পাওয়া যায় এদের মাধ্যমে। এপিস ফ্লোরিয়া জাতের মৌমাছিকেও বাক্সে পোষ মানিয়ে পালন করার চেষ্টা করছেন অনেকে। তবে সফল হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি এখনো। এরা ছায়াযুক্ত তেঁতুলগাছ, পাটিপাতাগাছ, অন্ধকারচ্ছন্ন জায়গায় বাসা তৈরি করে। এদের বাসায় সীমিত পরিমাণে মধু পাওয়া যায়। দেশে এই মৌমাছিদের বিচরণ ক্ষেত্রকে দুভাগে ভাগ করা যায়। লবণাক্ত অঞ্চল অর্থাৎ সুন্দরবন ও সংলগ্ন এলাকা এবং দেশের বাদবাকি মিঠাপানির এলাকা। তবে একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি মৌমাছি বসত গড়ে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের সঙ্গে মৌমাছির নিবিড় সম্পর্কই এ বৃহৎ ম্যানগ্রোভ বনটিকে হাজার বছর ধরে টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হয়। এই মৌমাছিরাই বিশাল বনজুড়ে বিপুল পরাগায়নে সহায়তা করে বনের গাছ ও ফল উৎপাদনে নিরলস সহায়তা করে যাচ্ছে।মৌচাক কেটে মধু নেওয়া হলে চাকের মৌমাছিরা পুনরায় বনের ফুলে ফুলে মধু সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে যেতে তৎপর হয়। এটা না করলে চাকে জমা মধু খেয়ে তারা ভারী হয়ে যায়, তাদের শক্তিও কমে যায়। মৌমাছিরা তৎপর না থাকলে, ফুলে ফুলে না বসলে বনে পরাগায়ন কমে যাবে। তাদের গাছের বংশবৃদ্ধির হার কমতে থাকবে। গাছ কমলে বিপজ্জনকভাবে ছোট হয়ে আসবে বনের পরিধি। এ জন্য বলা হয়, নতুন গাছের মাধ্যমে বনের বৃদ্ধি সচল রাখতে মৌমাছিরা বড় ভূমিকা রাখে। সুন্দরবন দুটি বিভাগে ভাগ করা আছে—সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ ও সুন্দরবন পশ্চিম বিভাগ। সরকারি হিসাবপত্রে দেখা যায়, মধু বেশি আহরণ হয় পশ্চিম সুন্দরবন থেকে।বন বিভাগ প্রায় অর্ধেক সুন্দরবনকে অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। ৫৫টি কম্পার্টমেন্টের মধ্যে ২২টিতেই প্রবেশ নিষেধ। স্থানীয় ভাষায় বনের এ অংশকে ‘বন্ধ বাদা’ বলে। সুন্দরবনের মৌয়াল সম্প্রদায় ‘বন্ধ বাদা’ থেকে মধু সংগ্রহ করতে পারে না। বন্ধ বাদা বা অভয়ারণ্যের ভেতর মৌচাক কাটা নিষিদ্ধ।তবে মৌচাক কাটা বন্ধ রাখা বনের জন্য কতটুকু ভালো, তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে। অন্য বনজ সম্পদ না কাটলে তা বাড়তে থাকবে। কিন্তু মৌচাক না কাটলে দিন দিন মধু ও মৌমাছি হ্রাস পেতে পারে। এতে পরাগায়ণ কমে তা বনের ওপর কী প্রভাব ফেলে, তা জানা জরুরি। তবে সাধারণভাবে সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও কঠোর তদারকির মাধ্যমে মৌচাক কাটা অব্যাহত রাখা বন ও মৌমাছি উভয়ের জন্যই উপকারী হবে বলে হয়। কারণ অমূল্য এই বনটিকে হাজার বছর টিকিয়ে রাখার জন্য ‘পরাগায়ন কৌশল’ কেবল মৌমাছিরই জানা আছে।এর মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। আগে বনের বাইরে শুধু খামারিরা মধুর জন্য মৌমাছি পালন করতেন। কিন্তু এখন মৌমাছি পালন অনেকটা সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। শহরে বাড়ির ছাদবাগানগুলোতে মৌ-বাক্স বসিয়ে মৌমাছি পালনের চল শুরু হয়েছে। এটা শহুরে উদ্ভিদের পরাগায়নে সহায়তা করবে এবং ছাদবাগানের ফসল ও বীজের উৎপাদন বাড়াবে। এতে দালানকোঠার শহর একসময় সবুজ হতে শুরু করবে।* সৈয়দ মুহাম্মদ মঈনুল আনোয়ার: মধু গবেষকপরিচালক, আল্ওয়ান (মধু গবেষণায় একটি ব্যক্তিগত উদ্যোগ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *